পোড়া খাবারের যত আইটেম আছে তা নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই আসে রেনুক দেবী চৌধুরীর নাম। তিনি তার বই “রকমারি নিরামিষ রান্না” নামক বইতে খুবই চমৎকার করে লিখেছে – পোড়া প্রথম পাতে পরিবেশন করতে হয়। ‘পোড়ার মুখে নাকি সব কিছুই ভাল লাগে’। শনি, মঙ্গলবার পোড়া খেলে শনির দৃষ্টি কাটে, এ কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি।
Table of Contents
পোড়া খাবারের যত আইটেম
১। আলু পোড়া
উপকরণ: নতুন ছোট আলু (খুব ছোট নয়) কয়েকটি, নুন, শুকনোলঙ্কা, ভাল তেল, পোস্ত দানা আধ চামচ।
প্রণালী: কয়লার নিভন্ত আঁচে বা কাঠকয়লার ছাইচাপা আগুনে আলুগুলো ধুয়ে সাজিয়ে দাও। গরম ছাই দিয়ে চেপে দিলেও ভাল হয়। কিছুক্ষণ পরে দেখো আলুর ওপরটা লালচে হয়ে পোড়া পোড়া হয়ে গেছে। আলুসিদ্ধ হয়েছে কিনা টিপে দেখো। সিদ্ধ হয়ে থাকলে আগুন থেকে আলু বার করে নিয়ে কাপড়ের টুকরো দিয়ে মুছে ছাই পরিষ্কার করে চটকে রাখো। লোহার কড়াতে পোস্তদানা ২-১ মিনিট নেড়েচেড়ে ভাজো, শুকনোলঙ্কা ১টি বা ২টি, আগুনে একটু পুড়িয়ে নাও। পোস্ত আধা গুঁড়ো করো। শুকনো লঙ্কা হাত দিয়ে গুঁড়ো করো। পোস্ত, লঙ্কা, নুন ও তেল দিয়ে পোড়া আলু মেখে খেতে দাও।
২। কচুপাতা পোড়া
উপকরণ: যে সব দেশি কচুতে গলা ধরে না সেইরকম দেশি কচুর, সবে বের হয়েছে এমন কচিপাতা, বেশ এক গোছা। কাঁচালঙ্কা ৪-৫টি, রসুন ৭-৮ কোয়া, পেঁয়াজ মাঝারি ১টি, পরিমাণ মতো নুন, মাখবার জন্যে সরষে তেল, ৪-৫ খণ্ড বড় কলাপাতা।
প্রণালী: কচুপাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে ডাঁটিটুকু কেটে বাদ দিয়ে, জল ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, সেই পাতা বিছিয়ে একটির ওপর একটি সাজাও। রসুনের খোসা ফেলে ২-৩ টুকরো করো। কাঁচালঙ্কা চিরে রাখো, পেঁয়াজের খোসা ফেলে মোটা লম্বা করে কাটো। কচুপাতার ভাঁজের ভেতর রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা দাও। কলাপাতার ওপর বসিয়ে কলাপাতা ৫-৬ পরত করে কচুপাতা জড়াও। ওপরটা কলাপাতার ছিলকা দিয়ে বেঁধে কাঠকয়লার উনুনের কয়লার ওপর উল্টেপাল্টে ধীরে ধীরে পোড়াও। ৩-৪ পরত কলাপাতা পোড়া হলে গরম ছাইয়ের ওপর কিছুক্ষণ রেখে, উনুন থেকে বার করে
সাবধানে কলাপাতা ছাড়িয়ে কচু পাতাগুলো বার করে একটি বাসনে রাখো। পেঁয়াজ, রসুন, লঙ্কা সহ খুব ভাল করে চটকাও। পরিমাণ মতো নুন দাও। কচুবাটা একটু বেশি সরষের তেল দিয়ে মাখতে হয়। কচুপাতার কোনও অংশ যদি একটু শক্ত থাকে সেটা ফেলে দাও। এই পাতাপোড়া খেতে বেশ ঝাল-ঝাল। আজকাল কাঠের উনুন চলে না। তাই চাটুতে উল্টে-পাল্টে পোড়ানো চলতে পারে।
৩। কাঁঠালবিচি পোড়া
উপকরণ: পুষ্ট কাঁঠালবিচি কয়েকটি, কাঁচালঙ্কা, পরিমাণ মতো নুন, মাখার জন্যে ভাল সরষের তেল, পেঁয়াজকুচি।
প্রণালী: উনুনে একটি লোহার কড়াতে কিছু বালি দিয়ে কাঁঠালের বিচিগুলি দাও। বালির নীচে বিচিগুলি ঢুকিয়ে দিয়ে একটি ভারী থালা দিয়ে ঢেকে দাও, না হলে বিচি ফুটে গায়ে লাগবে। মাঝে মাঝে ১টি বিচি উঠিয়ে টিপে দেখো নরম হয়েছে কিনা, নরম হলেই বালি থেকে বার করে বালি পরিষ্কার করে ঝেড়ে ওপরের খোসা ফেলে একটি বাসনে আঙুল দিয়ে চেপে ভেঙে নুন, তেল, কাঁচালঙ্কা মেখে খেতে দাও। গরম বালিতে কাঁঠালবিচি নরম হয়ে যাবার পর বেশিক্ষণ রাখতে হবে না, রাখলে শক্ত হয়ে যাবে। ইচ্ছা হলে পেঁয়াজকুচি দিতে পারো।
৪। পাকা পটল পোড়া
উপকরণ: বড় পুষ্ট পাকা পটল কয়েকটি, কাঁচালঙ্কা, পরিমাণ মতো নুন, ভাল সরষের তেল।
প্রণালী: পটলের গা চেঁছে ধুয়ে একটি শিকে গেঁথে অল্প আঁচে উল্টে-পাল্টে চারদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পোড়াও। ওপরের খোসা পোড়া পোড়া হবে। কিন্তু ভেতরটা হবে সুন্দর নরম। শিক থেকে খুলে মুছে পরিষ্কার করে একটি বাসনে রেখে চটকে মাখো। ঝালের জন্যে পছন্দ মতো কাঁচালঙ্কা মাখিয়ে দাও। নুন দাও, একটু বেশি তেল দিয়ে মাখো। বেশ সুন্দর একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরোবে। পটলের বিচিগুলি থেকে যাবে, এগুলোর স্বাদ বেশ মিষ্টি।
৫। বাবা গানুশ (বাগদাদি পদ)
উপকরণ: কচি বড় বেগুন ১টি, মাঝারি পেঁয়াজ ১টি, রসুনবাটা / চামচ, চিনি ১ চা-চামচ, খুব মিহি কিমার মতো পেঁয়াজকুচি বড় ১ চামচ, মাঝারি ১ চামচ ঘি, টক দই ২০০ গ্রাম, গোলমরিচ গুঁড়ো / চা-চামচ, পরিমাণ মতো নুন।
প্রণালী: বেগুন ধুয়ে কিছুটা চিরে নিয়ে, পেঁয়াজের পাতলা টুকরো কেটে বেগুনের
ভেতরে ভরে দিয়ে, বেশ চেপে বন্ধ করে বেগুন পুড়িয়ে নাও। সাবধানে উল্টে চারদিকেই
নরম করে পুড়িয়ে নিতে হবে। চারদিক সুন্দর নরম হয়ে গেলে, আগুন থেকে তুলে একটি থালায় রেখে কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখো। গরমে মোলায়েম হয়ে যাবে। ঢাকা খুলে ওপরের পোড়া খোসা সাবধানে ছাড়িয়ে ফেলো। এখন পরিষ্কার থালায় রেখে ভেতরের পেঁয়াজসহ খুব ভাল করে চটকে নাও। নুন চিনি দিয়ে মাখো। উনুনে কড়াতে ঘি চড়াও। মিহি পেঁয়াজকুচি দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে, মাখা বেগুন ঢেলে দিয়ে, বেশ করে হাতা দিয়ে ঘেঁটে নামিয়ে ফেলো। তারপর রসুনবাটা বেগুনে মেখে, একটি সুপ প্লেটে রাখো। দই খুব ভাল করে ফেটিয়ে নাও, যেন খিচ না থাকে। তারপর দইয়ের সঙ্গে পরিমাণ মতো নুন দাও। ফেটানো দই বেগুনের ওপর ঢেলে দাও। ওপরে গোলমরিচ গুঁড়ো ছড়িয়ে খাবার টেবিলে দাও।
৬। বেগুন পোড়া
শীতকালের একটি বিশেষ খাদ্য বেগুন পোড়া। নানা রকমের নানা জিনিস দিয়ে মেখে রুটি, ভাত, সবকিছুর সঙ্গেই খেতে ভাল লাগে। ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজকুচি, আদাকুচি, তেল, নুন ইত্যাদি দিয়ে মেখে মুখরোচক করে নাও।
১ নং প্রণালী: বিচি ছাড়া টাটকা বড় বেগুন ধুয়ে, মাঝখানে একটা ফালা দিয়ে বেগুনের ভেতরে কাঁচালঙ্কা ১টি বা ২টি, রসুন খোসা ও ছিলকা ছাড়ানো ২-৩ কোয়া, পেঁয়াজ ১টি, মোটা ফালা করে ভাল করে ভেতরে বসিয়ে, বেগুন চেপে ধরে বেগুনের গায়ে সামান্য তেল মাখিয়ে কম আঁচের আগুনে বেগুন দাও। একপিঠ পোড়া হয়ে এলে, সাবধানে অন্য পিঠ ঘুরিয়ে পোড়াও। চারদিক বেশ নরম হয়ে গেলে, বোঁটা ধরে সাবধানে থালায় নামিয়ে রাখো। কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখো। গরম একটু কমলে, বেগুনের পোড়া খোসা জলে হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে পরিষ্কার করে তুলে ফেলো। এখন পরিষ্কার বাসনে রেখে রসুন, পেঁয়াজ, লঙ্কা, নুন, তেলসহ ভাল করে চটকে মাখো। ঢাকা দিয়ে রাখবে। ঠাণ্ডা হলে স্বাদ ভাল লাগবে না।
২ নং প্ৰণালী: বেগুন পুড়িয়ে নামাও। বেগুনের খোসা ছাড়িয়ে মিহি করে ধনেপাতা কুচি, কাঁচালঙ্কাকুচি, নুন ও বেশি করে তেল দিয়ে একটু আধভাজা করে চটকে মাখো। ৩ নং প্ৰণালী: বেগুন পুড়িয়ে খোসা, ছাই ইত্যাদি পরিষ্কার করে মিহি করে কাটা
পেঁয়াজকুচি, কাঁচালঙ্কাকুচি, সরষের তেল ও নুন দিয়ে মাখো। ৪ নং প্রণালী: বেগুন পুড়িয়ে, পোড়া খোসা ইত্যাদি ফেলে পরিষ্কার করে থালায়
রাখো। আদাবাটা বা মিহি আদাকুচি, লঙ্কাকুচি, বেশি তেল ও নুন দিয়ে মাখো। ৫ নং প্রণালী: পোস্ত দিয়ে তৈরি ভাজার বড়ি, তেলে ভাল করে ভেজে রাখো (পুড়বে না, কাঁচাও থাকবে না)। বেগুন পুড়িয়ে খোসা ভাল করে পরিষ্কার করে, চটকে বেশি করে তেল, কাঁচালঙ্কা ও নুন দিয়ে রাখো। পরিবেশনের আগে বড়িভাজা গুঁড়ো করে এতে মিশিয়ে সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশন করো।
বেগুন পোড়ায় একটু বেশি তেল দিয়ে খেতে ভাল লাগে। কাঠের আগুনে পোড়া সবচাইতে ভাল হয়। কয়লাতেও মোটামুটি ভাল হয়। গ্যাস বা ইলেকট্রিকে তেমন সুবিধে ১২
হয় না। লোহার কড়াতে বেগুনে তেল মাখিয়ে কেটে, গ্যাস বা ইলেকট্রিকের মৃদু আঁচে এপিঠ-ওপিঠ করে পুড়িয়ে দেখেছি বেগুন পোড়া হয়, কিন্তু সুঘ্রাণ তত হয় না।
৭। রাঙাআলু পোড়া
উপকরণ: প্রয়োজন মতো রাঙাআলু, পয়রা গুড় বা ঘনদুধ, মিষ্টি দিয়ে জ্বাল দাও। কিংবা নুন, লঙ্কা, তেল দিতে হবে।
প্রণালী: তাজা টাটকা রাঙাআলু প্রয়োজন মতো নিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিবন্ত কয়লার আগুনে অনেকক্ষণ ধরে উল্টেপাল্টে পোড়াও। ওপরটা অল্প পোড়া হয়ে ভেতর পর্যন্ত নরম হয়ে যাবে। পোড়া হয়ে গেলে, ছাই থেকে উঠিয়ে ভিজে কাপড় দিয়ে ভাল করে মুছে আস্ত রাখো। পয়রা গুড় বা ঘনদুধ দিয়ে খেতে দাও। নুন, কাঁচালঙ্কা, সরষের তেল দিয়ে মেখে ভাতের সঙ্গেও ভাল লাগবে।
আরও পড়ুন: